আপনার সন্তানকে কেন আরবি ভাষা শেখানো উচিত?
লিখেছেন: শিব্বির আহমাদ, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী
মসজিদে ইমাম সাহেব জুমার খুতবায় সাধারণত বিষয় ভিত্তিক আলোচনা করেন। এটা যুক্তরাষ্ট্রের একটা মসজিদের কথা বলছি। আজকের খুতবার একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় ছিলো আরবি ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব! এ লেখায় আমি আরবি ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে ইমাম সাহেবের আলোচনার সারমর্ম তুলে ধরার চেষ্টা করবো, শেষে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কিছু পর্যবেক্ষণ লিখার চেষ্টা করবো।
আরবি ভাষা না বুঝার কারনে আমরা কুরআন হাদীসের টেক্সট থেকে সরাসরি শিখতে পারছি না; এমনকি নামাজে বা নামাজের বাহিরেও যেসব দোয়া বা জিকির আমরা করি সেগুলোও না বুঝেই শুধু মুখে বলি। এজন্য কুরআন শুনে সাহাবাদের মধ্যে যে আবেগ তৈরি হতো, কখনো আননন্দ, কখনো ভয়ের অনুভূতি তৈরি হতো আমাদের সেরকম হয় না। এমনকি মক্কার কাফেররাও আরবি ভাষা বুঝতো দেখে রাতে গোপনে রাসুলের (স.) এর তেলাওয়াত শুনতে যেতো, শুনে কান্নাও করতো; যদিও নিজেদের অহংকারের কারনে ইসলাম গ্রহণ করে নাই। অথচ আমাদের সে অনুভূতি হয় না পূর্ণ ঈমান থাকার পরেও। কারন আমরা যা বলছি, পড়ছি আরবিতে, সেগুলো আমরা বুঝি না।
রাসুলের (স.) খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন সাহাবী উবাই ইবনে কাব (রা.) বলেছেন- সন্তানদেরকে আরবি ভাষা শিখাও, কুরআন মুখস্থ করার চেয়েও আরবি ভাষা শিখা বেশি জরুরী (তিনি নিজেও হাফেজ ছিলেন)!
আবু বকর (রা.) বলেছেন – আমি কোরআন মুখস্থ করি, আবার ভুলে যাই; এটা যতো কষ্টকর, তার চেয়েও বেশি কষ্টকর হচ্ছে আরবি ভাষার ব্যাকরণগত ভুল যদি আমি করি!
উমর (রা.) কোন একজন সৈন্যকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন – মিলিটারি মিস্টেইকের চেয়েও আরবি ভাষা ভালো না জানা বা সেখানে ভুল করা বেশি বিপজ্জনক!
ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেন – ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা বা ভুল বুঝাবুঝিগুলোর বেশিরভাগের উৎস হলো আরবি ভাষা না জানা! এবং চরমপন্থার কারণ ও অনেক ক্ষেত্রে আরবি ভাষার ভালো জ্ঞান না থাকার কারণে কুরআনের টেক্সট বুঝতে না পারা!
আমাদের প্রচুর হাফেজ আছে, আরবি ভাষা বুঝার লোক নাই। ইমাম সাহেব বলতেছেন- কুরআন মুখস্থ করার চেয়েও বুঝা বেশি জরুরি। সন্তানদেরকে আরবি ভাষা শিখানো অনেক দরকার ছোটবেলা থেকেই। ইমাম সাহেব মসজিদে আরবি ভাষার ক্লাস করান! কীভাবে বড়দের পক্ষেও শিখা সম্ভব সেগুলো বলছিলেন। অনেক সিনিয়র প্রফেশনালরাও শিখেন, ব্যস্ত ডাক্তাররাও ক্লাসে আসেন! শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাটা বুঝতে পারলে আর আগ্রহ তৈরি হলে সব বয়সের মানুষের পক্ষেই কমপক্ষে বেসিক কুরআনিক আরবি ভাষা শিখা সম্ভব। তিনি প্রশ্ন করেন- আজকে যদি আপনাকে বলা হয় কোন একটা নতুন ভাষা শিখলে আপনার বেতন দ্বিগুন হয়ে যাবে, তখন আপনি কি করবেন? নিশ্চয়ই শিখবেন! প্রফেশনাল প্রয়োজনে আমরা অনেকেই বিভিন্ন ভাষা শিখি! চেষ্টা করলে আরবি শিখাও সম্ভব!
বাংলাদেশে আমাদের হাফেজি মাদ্রাসাগুলোর আধুনিকায়ন করা গেলে হাফেজির পাশাপাশি ভাষা শিখানোর ব্যবস্থাও করা যেতো! মক্তবগুলোতেও একটা পর্যায়ের আরবি ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ড. ইউসুফ আল কারজাভীও এ নিয়ে আফসোস করে বলেছিলেন- আমাদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে: আমাদের আলেমদের অনেকেই হাফেজ নন, আবার বেশিরভাগ হাফেজ আলেম হোন না।
অ্যারাবিক মিডিয়াম মাদ্রাসা বা অ্যারাবিক + ইংলিশ মিডিয়াম মাদ্রাসার সংখ্যা বাড়ানো দরকার। বিশেষ করে বড় শহরগুলোতে যারা নতুন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করছেন, তারা আরবি ও ইংরেজি মাধ্যমের মাদ্রাসা করতে পারেন। শুধুমাত্র উচ্চবিত্তকে টার্গেট করেও এ ধরণের প্রতিষ্ঠান করা যায় যেহেতু এগুলো এক্সপেন্সিভ হতে পারে।
আমাদের মাদ্রাসা/স্কুল গুলোতে ভাষা শিখানোর পদ্ধতি খুবই সেকেলে, সেটা ইংরেজির বেলায়ও! ভাষা শিক্ষার আধুনিক পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করে মাদ্রাসাগুলোতে সেকেন্ডারি লেভেলে দুই বছরের আলাদা প্রজেক্ট নিয়ে আরবি এবং ইংরেজি ভাষা শিখানোর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
স্কুলগুলোতে তো আরবি হারিয়ে গেছে, সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে ইংরেজির পাশাপাশি আরবি ভাষাও শিখার ব্যবস্থা করা উচিত। প্রাইভেট স্কুলগুলোতে অপশনাল হিসেবে আরবি ভাষা শিক্ষার কোর্স রাখা যেতে পারে। আমেরিকার হাইস্কুলগুলোতে বাচ্চারা যেকোন একটা সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজ শিখার সুযোগ পায় (ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, অ্যারাবিক ইত্যাদি)।
দুঃখজনক বিষয় হলো- বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই আরবি ভাষা না শিখেই ইসলামিক স্টাডিজের আন্ডারগ্র্যাড, মাস্টার্স শেষ করছে। এটা মনে হয় শুধুমাত্র বাংলাদেশের ইউনিক ঘটনা। দুনিয়ার আর কোথাও কেউ আরবি ভাষা না শিখেই ইসলামিক স্টাডিজ পড়বে এটা কল্পনা করা যায় না; এমনকি পশ্চিমের কোন কোন অমুসলিম ও যখন ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা করে বা করতে চায়, তারা আরবি ভাষা শিখে নেয়। না হলে ডিরেক্ট সোর্স থেকে তো জ্ঞান আহরণ করতে পারবে না। বাংলাদেশের ইসলামিক স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টগুলো প্রথম বর্ষেই আরবি ভাষা শিক্ষার ইনটেনসিভ কোর্স চালু করতে পারে। বিদেশে যারা পড়তে যাচ্ছে তারা কিন্তু ভাষা শিখছে। চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন ইংরেজি মাধ্যমে পড়ায় বলে তারা তাদের ছাত্রীদের প্রথম বর্ষে ইনটেনসিভলি ইংরেজি ভাষার কোর্স করায়। ইসলামিক স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টগুলো এ উদ্যোগ নিতে পারে।
সরকারি বেসরকারি কিছু স্কুলে আগে অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত বেসিক লেভেলের আরবি ভাষা শিখানোর প্রচলন ছিলো। বাংলাদেশি সেক্যুলারদের কুবুদ্ধি এবং চক্রান্তে সেগুলো এখন বন্ধ প্রায়। পঞ্চম অষ্টমে পাবলিক পরীক্ষায় আয়োজন করে সেগুলোতে শেষ পেরেক দেয়া হয়েছিলো। এখন তো ইসলাম শিক্ষা ও সে অর্থে নেই। কিন্তু এই তথাকথিত সেক্যুলাররা এসবের মাধ্যমে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের ধর্মের জ্ঞানার্জনের ফরমাল পথ বন্ধ করে তরুন সমাজকে বিপথগামী করছে। তারা যেহেতু ধর্মের মূল টেক্সট বুঝার মতো জ্ঞান অর্জন করতে পারেনি, ভুলভাল সোর্স থেকে কথা শুনে বিপদগামী হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে এটা দেখা গেছে যে ইংলিশ মিডিয়াম বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা চরমপন্থী হয়ে যাচ্ছে।
আরবি ভাষা জানলে মানুষ সরাসরি কুরআন হাদিসের টেক্সট থেকে ইসলাম শিখতে পারবে। তাহলে ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা থেকে উদ্ভুত চরমপন্থা বা বিভেদ গুলো কমে আসবে!
যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সাথে জড়িত আছেন, তারা ভাবতে পারেন। মা-বাবারা বাচ্চাদেরকে ছোট থেকে বাংলা, ইংরেজি, আরবি তিনটা ভাষা-ই শিখানোর উদ্যোগ নিতে পারেন। ছোট বেলায় শিখানো অবশ্যই উত্তম! আর যারা স্কলার হবে, ইমাম হবে, দাওয়াতের কাজ করবে, ওয়াজ মাহফিলে বা মসজিদে জুমার খুতবা দিবে তাদের তো অবশ্যই আরবি ভাষার এক্সপার্ট হওয়া জরুরি! তাই মা বাবারা বাচ্চাদেরকে ছোটবেলা থেকেই সেভাবে গড়ে তুলতে পারেন।